Category Archives: বাংলা আর্টিকেল।

কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এ পৃথিবী?(বেদ ও বিজ্ঞান)

কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এ পৃথিবী? আদিকাল থেকে এখনো পর্যন্ত এ যেন মানুষের এক অনন্ত জিজ্ঞাসা। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বেদ এর বিখ্যাত নাসাদিয় সুক্ত এবং হিরন্যগর্ভ সুক্ত এর কথা অনেকেই জানেন।ধর্মবিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী মহলে বহুল আলোচিত এই দুটি সুক্তের আলোকে সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
ঋগবেদ ১০/১২৯/১
“নাসাদাসিস নঃ সদাসিত্ তদানীম নাসিদ রজ ন ব্যামাপ্রো যৎ…”
“শুরুতে কোন অস্তিত্ব(সৎ) বা অনস্তিত্ব(অসৎ) ছিলনা।সেখানে ছিলনা কোন বায়ুমন্ডল”
ঋগবেদ ১০/১২৯/৩
“তম অসিৎ তমস… তপসস্তন্মহিনাজা
য়াতৈকম”
“চারদিক ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন।সমস্ত জিনিস একত্রে পুন্জীভুত ছিল।সেখান থেকে প্রচন্ড তাপের সৃষ্টি হল”
একইভাবে
ঋগবেদ ১০/১২১/১
“হিরন্যগর্ভ সামাভরতাগ্রে..”
“প্রথমেই হিরন্যগর্ভ সৃষ্টি হল”
ঋগবেদ ১০/১২১/৭
“আপ হ য়দ বৃহাতিরিবিশ্বমায়ান গর্ভম…”
“সেই হিরন্যগের্ভ ছিল উত্তপ্ত তরল যাতে ছিল সৃষ্টির সমস্ত বীজ”
একই ধরনের কথা বলছে শতপথ ব্রাক্ষ্মন ১১.১.৬.১
“হিরন্যগর্ভানি অপঃ তে সলিলা…”
“প্রথমে হিরন্যগর্ভ সৃষ্টিহল।সেখানে
ছিল উত্তপ্ত গলিত তরল।এটি ছিল মহাশুন্যে ভাসমান।বছরের পরবছর এই অবস্থায় অতিক্রান্ত হয়।”
ঋগবেদ ১০.৭২.২
“তারপর যেখানে বিস্ফোরন ঘটল গলিত পদার্থ থেকে,বিন্দু থেকে যেন সব প্রসারিত হতে শুরু হল”
ঋগবেদ ১০.৭২.৩
“সেই বিস্ফোরিত অংশসমূহ থেকে বিভিন্ন গ্রহ,নক্ষত্র তৈরী হল”
ঋগবেদ ১০.৭২.৪
“তার এক জীবনপ্রদ অংশ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হল”
ঋগবেদ ১০.৭২.৮-৯
“তারপর সৃষ্ট ক্ষেত্রে সাতধাপে সংকোচন-প্রসারন সম্পন্ন হল।তারপর সৃষ্টি হল ভারসাম্যের।”
এই অংশটুকু পরলেই স্পষ্ট বোঝা যায় বেদের সৃষ্টিতত্ত আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ।সৃষ্টিতত্তের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মডেল “Lambda-CDM Concordance Model” অনুযায়ী “The evolution of the universe from a very uniform, hot, dense primordial state to its present অর্থাৎ একটি উত্তপ্ত, কেন্দ্রীভূত আদি অবস্থা থেকেই বর্তমান অবস্থার উত্থান।” এছাড়া বেদএ উল্লেখিত বিস্ফোরণ বর্তমান বিশ্বের বহুল আলোচিত বিগ ব্যাংগ তত্তের সাথে প্রায় পুরোপুরি মিলে যায়।
আশ্চর্যের এখানেই শেষ নয়।বেদ এর মতে সৃষ্টির শুরুতেই ওঁম উচ্চারিত হয় আর এর প্রভাবেই হয় বিস্ফোরন ।
বেদান্ত সূত্র(4/22) “অনাবৃতিঃ শব্দহম” অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমেই সৃষ্টির শুরু যা মাত্র দুই বছর আগে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন।
এই শব্দ তরঙ্গকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় Cosmic sound wave বলা হয়। ইউনিভার্সিটি অব এরিজোনা এর এস্ট্রোনমির প্রফেসর ডেনিয়েল জে আইনস্টাইন এবং জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ্যার প্রফেসর চার্লস বার্নেটের সম্মিলিত আর্টিকেল “Cosmic sound wave rules” থেকে কি করে এই শব্দের মাধ্যমে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হল তার ব্যখ্যা দেয়া হল। আমরা জানি যে সৃষ্টির শুরুতে মহাবিশ্ব ছিল একটি ঘন,উত্তপ্ত পিন্ড(বেদের ভাষায় হিরন্যগর্ভ বা হিরন্ময় ডিম)।
এই পিন্ডের মধ্যস্থিত পদার্থসমূহকে Cosmologist রা দুই ভাগে ভাগ করেন-Baryonic&Non-baryonic.Baryonic পদার্থ হল ইলেকট্রন,প্রোটন ও নিউট্রন।এইসময় এরা সকলেই ছিল আয়নিত অবস্থায়। প্রসারন শুরু হবার জন্য মূল ভূমিকা ই ছিল এই উত্তপ্ত ও আয়নিত Baryonic পদার্থগুলোর মধ্যস্থিত ইলেকট্রনগুলোর মাধ্যমে নিঃসৃত ফোটন কনাগুলো(Compton scattering of photon from electron)।এই ফোটন কনাগুলো উত্তপ্ত প্লাসমার সাথে Baryon-photon fluid তৈরী করে।কনাসমূহের মধ্যে সংঘর্ষের কারনে এই Fluid এর সংকোচন ঘটে কিন্তু এই সংকোচিত প্লাসমাই ফোটনসমূহকে উচ্চ বেগে বিচ্ছুরিত করে।যে স্থান থেকে ফোটনসমূহ নির্গত হয়ে যায় সেই স্থান ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় সেখানে একটি নিম্নচাপ যুক্ত স্থান তৈরী হয় যা তার চারদিকের Fluid দ্বারা চাপ প্রাপ্ত হয়।আর এই চাপই সেই পানিতে একটি শব্দ তরঙ্গের সৃষ্টি করে,শুধু পার্থক্য হল এই যে এখানে কাউকে মুখে শব্দ করে তরঙ্গ তৈরী করতে হয়নি বরং ফোটন নির্গত হয়ে যাওয়ায় সৃষ্ট চাপের কারনেই এই তরঙ্গের তৈরী হয়। আর বৈদিক সৃষ্টিতত্ত্ব মতে এই শব্দ হল ওঁ! তাই বেদের সৃষ্টিতত্ত পড়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এর Dr. Kevin Hurley বলেছিলেন
“How could Aryan sages have known all this 6000 years ago, when scientists have only
recently discovered this using advanced equipments which didn’t exist that time!”
নোবেল লরেট Count Maurice Maeterlinck বৈদিক সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বলেন “A Cosmogony which no European conception has ever surpassed!”

প্রশ্ন- আপনারা আর্যরা শুধু বেদ বেদ করেন অথচ গীতাতো বেদকে পুষ্পিত বাক্য বলেছে ও বিবেকবর্জিত লোকেরাই এর দ্বারা আসক্ত হয় বলেছে।

উত্তর-বেদ, বেদান্ত ও উপনিষদ আপনি বা আপনারা মনে হয় চোখেও দেখেন নাই অধ্যায়ন তো দূরের কথা।
আর গীতা থাকলেও পুরোটা অধ্যায়ন করেছেন বলে মনে হয় না অথবা পড়লেও বুঝেছেন বলে মনে হয় না। বেদ বেদান্ত উপনিষদে নাই গেলাম, ইসকনের গীতা ও তাদেরই করা তাৎপর্য থেকেই আপনার কথাটা মিথ্যা প্রমাণ করে দিচ্ছি। দেখুন- . গীতার ২।৪২ও৪৩নং শ্লোকে আপনার কথাটাই বলা আছে, তবে বেদের চরম উদ্দেশ্য যে এটা নয় তা গীতার ১৫।১৫ স্পষ্ট বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে “আমিই (ঈশ্বরই) সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ” অর্থাৎ বেদের একমাত্র জানার বিষয় ঈশ্বর। . গীতা২।৪৬নং শ্লোকের তাৎপর্যে ইসকনের গীতায় বলা হয়েছে “বেদে যে কর্মকান্ড ও আচার অনুষ্ঠান ও যাগ যজ্ঞের বিধান দেওয়া আছে তার উদ্দেশ্য জীবকে ক্রমশ আত্ম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে উৎসাহিত করা।” . এখন প্রশ্ন হল যারা আত্ম তত্ত্বজ্ঞানী তারা কি ঐ সব নিত্যকর্ম যথা যজ্ঞ আচার অনুষ্ঠান করবে না? এর উত্তর গীতাতেই বলা আছে দেখুন- . “তুমি শাস্ত্রোক্ত কর্মের অনুষ্ঠান কর .. কর্ম না করে কেউ দেহযাত্রাও নির্বাহ করতে পারেনা। ভক্তরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন, কারণ তারা যজ্ঞাবশিষ্ট অন্নাদি গ্রহণ করেন। আর যারা নিজের জন্যই কেবল অন্ন পাক করে তারা কেবল পাপই ভোজন করে। আর প্রাণীর জীবন ধারণ থেকে শুরু করে বৃষ্টি ও অন্ন উৎপাদন তা সব শাস্ত্রোক্ত (বেদ) কর্ম থেকে যজ্ঞ উৎপন্ন হয়। বেদ থেকেই যজ্ঞাদি কর্ম উৎপন্ন হয়েছে। বেদ অক্ষর বা পরমেশ্বর থেকে প্রকাশিত। যে ব্যক্তি এই জীবনে বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞ অনুষ্ঠান না করে, সে পাপী ব্যক্তির জীবন ধারণ করা বৃথা।” # গীতা ৩।৮-১৬. সংক্ষেপে. . তাহলে কেন গীতায় পূর্বে বেদকে বিবেক বিবেকবর্জিত পুষ্পিত বাক্য বলেছে? বেদকে বিবেক বর্জিত বাক্য বলেনি, বলেছে বিবেকবর্জিত লোকেরা বেদের পুষ্পিত বাক্যগুলোকে না বুঝে সকাম কর্ম করে। প্রকৃত পক্ষে বেদের মোক্ষ উদ্দেশ্য যারা ধর্মের কিছুই করে না ও বুঝে না তাদেরকে সকাম কর্মের মাধ্যমে ধর্মের পথে নিয়ে এসে নিষ্কাম কর্মে নিয়োজিত করার মাধ্যমে মুক্তি সুখ দেওয়া। গীতাতেই তাই বলা আছে- “ফলভোগের কামনা পরিত্যাগ করে যোগস্থ হয়ে স্বধর্ম বিহিত কর্ম আচরণ কর।” গীতা২।৪৮. . বেদ যদি শুধুমাত্র বিবেক বর্জিত বাক্যই হতো তাহলে কেন গীতায় যজ্ঞ নিয়ে নিম্নোক্ত কথাগুলো বলা হল? দেখুন- . “কেউ দ্রব্য দান রূপ যজ্ঞ করেন, কেউ তপস্যারূপ যজ্ঞ, কেউ অষ্টাঙ্গ ও কেউ পরমার্থিক জ্ঞান লাভের জন্য বেদ অধ্যায়নরূপ যজ্ঞ করেন। যজ্ঞের প্রভাবে পাপ থেকে মক্ত হয়ে তারা যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত আস্বাদন করেন এবং সনাতন ব্রহ্মকে লাভ করেন। হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যজ্ঞ অনুষ্ঠান না করে কেউই এই জগতে সুখে থাকতে পারে না, তা হলে পরলোকে সুখপ্রাপ্তি কি করে সম্ভব? এই সমস্ত যজ্ঞই বৈদিক শাস্ত্রে অনুমোদিত হয়েছে…সেগুলোকে যথাযথ ভাবে জানার মাধ্যমে তুমি মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করতে পারবে। দ্রব্যময় যজ্ঞ থেকে জ্ঞানময় যজ্ঞ শ্রেয়। সমস্ত কর্মই পূর্ণরূপে জ্ঞানরূপ যজ্ঞে গিয়ে শেষ হয়।” #গীতা ৪।২৮-৩৩. . এখন প্রশ্ন হল অগ্নিহোত্রাদি কর্ম কি করা উচিত না অনুচিত? এই ব্যাপারে গীতাতেই বলা আছে যে- “যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন এবং দৈহিক চেষ্টাশুন্য তিনি সন্ন্যাসী বা যোগী নয়। যিনি কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করে কর্তব্য কর্ম করেন তিনিই যথার্থ সন্যাসী বা যোগী।” গীতা ৬।১. এখন আমার প্রশ্ন ইসকনের প্রভুরা প্রতিদিন দ্রব্য যজ্ঞ করেন কিনা? . গীতার ১৩।১নং শ্লোকে অর্জুন যখন কৃষ্ণের কাছে ক্ষেত্র ও ক্ষত্রজ্ঞ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, তখন কৃষ্ণ একটু বলার পরেই বলেছেন- . “ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের জ্ঞান ঋষিগণ কর্তৃক বিবিধ বেদবাক্যের দ্বারা পৃথক পৃথক ভাবে বর্ণিত হয়েছে। বেদান্তসূত্রে তা বিশেষ ভাবে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত সহকারে বর্ণিত হয়েছে।”গীতা ১৩।৫. বেদ বেদান্ত যদি তথাকথিত বিবেক বর্জিত বাক্যই হত তাহলে কেন কৃষ্ণ বেদ বেদান্ত ও বৈদিক শাস্ত্রের কথা বার বার বলছেন? প্রকৃত পক্ষে কৃষ্ণ এটাই বলেছেন যে যারা বেদের মূল ভাব বুঝেনা তারা বিবেক বর্জিত। . বেদ যে প্রকৃত পক্ষে কি তা বুঝার জন্য গীতার ১৫।১-৬নং শ্লোকই যথেষ্ট, দেখুন- . “উর্ধ্বমূল ও অধঃশাখা যুক্ত একটি নিত্য অশ্বথু বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে। বৈদিক মন্ত্রগুলো সেই বৃক্ষের পত্রস্বরূপ। যিনি বৃক্ষটিকে যানেন তিনিই বেদজ্ঞ। বৃক্ষের শাখাগুলো অধোভাগ ও উর্ধ্বভাগে বিস্তৃত, উহার বাসনারূপ মূলগুলো মানুষ্যলোকে অধোভাগে বিস্তৃত রয়েছে। সেগুলো মনুষ্যলোকে সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করে। এই সংসারে স্থিত জীবেরা উর্ধ্ব মূলের স্বরূপ উপলব্দি করতে পারে না। আদি,অন্ত ও স্থিতি যে কোথায় তা কেউ বুঝতে পারে না। তীব্র বৈরাগ্যরূপ শস্ত্রদ্বারা ছেদন করে সত্য বস্তুর অন্বেষণ করা কর্তব্য, যেখানে গমন করলে পুনরায় ফিরে আসতে হয় না। ‘আমি সেই আদি পুরুষের শরণ লইতেছি’ এই বলিয়া তার অন্বেষণ করতে হবে। যারা অভিমান ও মোহশুন্য, সঙ্গদোষ রহিত, নিত্য অনিত্য বিচার পরায়ন,কামনা বাসনা বর্জিত… তারা সেই পরম অব্যয় পদ লাভ করেন।..সেখানে গেলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।” # গীতা১৫ ।১থেকে৬নং সংক্ষেপ। . শাস্ত্র তথা বেদ বিধি যারা পরিত্যাগ করে তাদের কি গতি হবে ও বেদই যে একমাত্র প্রমাণ তা গীতা থেকেই দেখুন- . “যে শাস্ত্র বিধি পরিত্যাগ করে কামাচারে বর্তমান থাকে সে পরম গতি লাভ করতে পারে না। অতএব, কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। শাস্ত্রে যে কর্ম বিধান বলা হয়েছে, তা জেনে তুমি সেই কর্ম করতে যোগ্য হও।”গীতা ১৬।২৩ও২৪. . “ফলের আশা রহিত ব্যক্তিগণ শাস্ত্রের বিধি অনুসারে অনুষ্ঠান করা কর্তব্য এভাবেই মনকে একাগ্র করে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তা সাত্বিক যজ্ঞ। শাস্ত্র বর্জিত যজ্ঞকে তামসিক যজ্ঞ বলে। গীতা ১৭।১১,১৩। . বেদ উক্ত কর্ম কি ত্যাগ করা উচিত?গীতা বলিতেছে- . যজ্ঞ, দান ও তপস্যা ত্যাজ্য নয়,তা অবশ্যই করা কর্তব্য।গীতা ১৮।৫

বেদ ও দস্যু, আর্য আক্রমণ তথ্য একটি ভ্রান্ত ধারণা।

ম্যাকলের কুটিল শিক্ষা নীতির কারনেই অনেক ভারতীয় বিদ্বান ইহা মানে যে, বেদের মধ্যে কথিত আর্য এবং দস্যুদের সংঘর্ষের বর্ননা রয়েছে। আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে এসেছে। ভারতের মূল নিবাসী দাস বা দস্যু ছিলো, যাদের আর্যরা এসে পরাজিত করে দাস বানিয়েছে। কঠোর ব্যবহার করে তাদের নিচু কাজ করিয়ে এবং সর্বদার জন্য ভারতবর্ষের উপর আধিপত্য স্থাপন করেছেন। এবং এই দেশের সত্যনাশ করার ষড়যন্ত্রের শামিল অনেক সাম্যবাদি ইহাই বলে যে, আর্যরা নিজ মহত্বকে জন্মগত ভেদভাবের আধারের উপর প্রতিস্থাপিত করেছেন। ভারতবর্ষকে বিভাজিত কারী এই বিচারের কারনে আজ স্বয়ং কে দ্রবিড় তথা দলিত ভাই- বোন যে নিজেকে নিজে অনার্য মানে।তাদের মনে বেদের প্রতি ঘৃণা এবং দ্বেষের বিষ ভরে গেছে। ডাঃ আম্বেডকার ও তাদের এই বিচারে সহমত ছিলো না। কারন এই মিথ্যা বিবাদ বেদের উপর আরোপ করা হয়েছে। এখান থেকে আর্য আক্রমন তত্ত্বের মিথ্যাচারের গল্পটি পড়ুন-
http://www.agniveerbangla.com/Aryan%20Invasion%20is%20False.html
অতএব এখন দেখার বিষয় বেদের মধ্যে আর্য এবং দস্যুর বাস্তবিক অর্থ কি?
মূলত ইহাই এই লেখার মূল উদেশ্য।
.
=>> আরোপঃ বেদের মধ্যে অনেক স্থানে আর্য এবং দস্যুদের বর্ণনা রয়েছে। অনেক মন্ত্রে দস্যুদের বিনাশ তথা আর্যের রক্ষার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। কিছু মন্ত্রে তো ইহা বলা হয়েছে যে, স্ত্রী যদি দস্যু হয় তবে তাকেও নিষ্কৃতি দেওয়া উচিত নয়। এ থেকে জানা যায় যে, বেদের মধ্যে দস্যুদের উপর আর্যের অত্যন্ত ঘাতক আক্রমনের বর্ণনা রয়েছে।
.
=>> সমাধানঃ-
ঋগবেদের মধ্যে দস্যু সংশ্লিষ্ট ৮৫ টি মন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে কিছু মন্ত্র আমরা পর্যালোচনা করবো-
=> হে শূরবীর রাজন! বিবিধ শক্তিযুক্ত আপনি একাকি বিচরন করে নিজ শক্তিশালী অস্ত্র দ্বারা ধনিক দস্যু (অপরাধী) এবং সনকঃ ( অধর্ম দ্বারা অন্যের ধন ছিনতাইকারী) কে বধ করুন। আপনার অস্ত্র দ্বারা তাহার মৃত্যু প্রাপ্ত হোক।
(ঋগবেদ ১।৩৩।৪)
.
এখানো “সতকঃ” শুভ কর্ম রহিত। এবং দস্যুর জন্য “অয়জ্ব” বিশেষন এসেছে অর্থাৎ যে সৎকর্ম রহিত। এবং ওইরূপ ব্যক্তিই পাপকারী ও অপরাধী হয়। অতএব এখানে রাজা প্রজার রক্ষার জন্য ঐ রূপ লোককে বধ করার জন্য বলছেন। সায়ন এই মন্ত্রে দস্যু শব্দের অর্থ চোর করেছেন। দস্যু শব্দটি “দস” ধাতু থেকে এসেছে যার অর্থ ” উপক্ষয়া”যে নাশ করে। অতএবঃ দস্যু কোন আলাদা জাতি নয়। পরন্তু দস্যু শব্দের অর্থ বিনাশকারী এবং অপরাধী প্রকৃতির লোক।
.
=>> যে দস্যু (দুষ্ট জন) শুভ কর্ম রহিত ও শুভকারীর সাথে দ্বেষ রাখে, আপনার রক্ষার প্রতাপ দ্বারা সে দূরে যাক। হে পরাক্রমী রাজেন্দ্র! আপনি সব স্থানে “অব্রত” (শুভ কর্ম রহিত) জন কে বাহিরে দূর করুন।
(ঋগবেদ ১।৩৩।৫)
.
এখানেও দস্যুর বিশেষন এসেছে “অয়জ্ব”( শুভ কর্ম রহিত এবং “অব্রতঃ (নিয়ম অপলানকারী তথা অনাচারী। পরিষ্কার যে, দস্যু শব্দ অপরাধীর জন্য এসেছে এবং সভ্য সমাজে ঈশ্বর ঐ সব লোক কে দন্ডের বিধান দিয়েছে।
.
=>> হে বীর রাজন! এই রোদনরত বা হাস্যরত দস্যু কে এই লোক থেকে দূর করে দিন এবং তাকে নষ্ট করে দিন। তথা যে শুভ কর্মযুক্ত তথা ঈশ্বরের গুনগান কারী মানুষ তাকে রক্ষা করুন।
(ঋগবেদ ১।৩৩।৭)
.
=>> হে রাজেন্দ্র! আপনি নিজের দক্ষতা দ্বারা কম্পনযুক্ত “অয়জ্বা , অব্রতী ” দস্যুকে কম্পায়মান করুন। যে প্রত্যেক বস্তুর উপভোগ কেবল স্বয়ং এর জন্য করে সেই দুষ্ট কে দূর করুন। হে মানুষের রক্ষক! আপনি উপদ্রব, অশান্তি উৎপন্নকারী দস্যুর নগর কে নষ্ট করুন।
(ঋগবেদ ১।৫১।৫)
.
এই মন্ত্রে দান পরোপকার রহিত, সবকিছু স্বয়ং ব্যায়কারী কে দস্যু বলা হয়েছে। কৌষিতকী ব্রাহ্মণে ঐ সব লোক কে অসুর বলা হয়েছে। অতএব দস্যু এবং অসুর দুইএর তাৎপর্য দুষ্ট অপরাধী।
.
=>> পরমেশ্বর আপনি আর্য ও দস্যুকে উত্তম প্রকারে জানেন। শুভ কর্মকারীর জন্য আপনি অব্রতী (শুভ কর্মের বিরোধী) দস্যুকে নষ্ট করুন। হে ভগবন! আমি উত্তম কর্মের প্রতি পালনের জন্য আপনার প্রেরনা সদা প্রার্থনা করি।
(ঋগবেদ ১।৫১।৭)
.
=>> হে রাজেন্দ্র! আপনি নিয়মের পালনকারী তথা শুভকর্ম কারীর কল্যান হেতু ব্রতরহিত দস্যুকে সংহার করুন। স্তুতি কারীর সাথে দ্বেষ রাখা,অনাচারী ঈশ্বরের গুনগান রহিত লোক কে বশে রাখুন।
(ঋগবেদ ১।৫১।৯)
.
=>> হে পরম ঈশ্বর্যবার রাজা! আপনি তিন প্রকারে সাধারন,স্পর্ধা ও সুখ কে বৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম মধ্যে যজমানস্ আর্যম( উত্তম,গুন ও স্বভাব লোক) কে রক্ষা করুন। এবং অব্রতান্ (দুষ্ট আচরনকারী) যার অন্তঃকরন মলিন হয়ে গেছে। হিংসারত ও হিংসা ইচ্ছাকারী কে নষ্ট করুন।
(ঋগবেদ ১।১৩০।৮)
.
এখানে কৃষ্ণ ত্বক শব্দটি এসেছে যার অর্থ অন্তঃকরনের দুষ্ট ভাব। এবং সাথে তনৃষাণাম এবং অর্শসানম শব্দ এসেছে। যার অর্থ হিংসা করতে চায় বা হিংসা রত। ইহার বিপরীত শব্দ আর্য এখানে শ্রেষ্ঠ এবং পরোপকারী মানুষের জন্য এসেছে।
.
অতএব উত্তম স্বভাববান শান্তিপ্রিয়, পরোপকারী কে আর্য তথা অনাচারী এবং অপরাধী প্রবৃত্তিবান কে দস্যু বলে। ঋগবেদ ৬।২২।১০ এ আমাদের দাসকেও আর্য বানানোর শিক্ষা দেয়। পরিষ্কার যে আর্য ও দস্যু একটি ব্যক্তির গুনবাচক নাম কোন জাতিবাচক নাম নয়।
ঋগবেদ ৩।৩০।২৭ তথা ৭।১০৪।২ মন্ত্রে ব্রহ্মদ্বেষী, নরভক্ষক এবং কুটিল লোককে যুদ্ধের দ্বারা বশ রাখতে বলেছেন। ব্রহ্মদ্বেষী, নরভক্ষক এবং কুটিল লোক ও কোন আলাদা জাতি নয়। অপরাধী প্রবৃত্তির লোক কে দাস,দস্যু এবং ব্রহ্মদ্বেষী বলে।
বিদ্বান ব্যক্তিরা ইহা জানে যে, সৎ (সত্য) এবং অসৎ (অসত্য) পরস্পর সংঘর্ষ করতেই থাকে। সৎ অসৎ কে এবং অসৎ সৎ কে সর্বদা বশে রাখার চেষ্টা করে। এই দুই এর মধ্যে যে সৎ এবং ঋত (শাশ্বত সত্য) তাহকেই ঈশ্বর সদা রক্ষা করেন। এবং অসৎ কে হনন করেন।
তাই আসুন মিথ্যা অভিমান ত্যাগ করে ফিরে আসি ঋত ঋদ্ধির পথে।