মনুস্মৃতি ন্যায় ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় একটি পুস্তক। একটি রাজ্য শাসন এবং পরিচালনা করার জন্য কতগুলো নির্দিষ্ট আইন থাকে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে অন্যায়কারীদের উপযুক্ত দন্ড প্রদান করা। মহর্ষি মনু মহারাজ তার বচনে সমাজ ব্যবস্থা এবং অপরাধীদের শিক্ষা দেবার জন্য কিছু দন্ড বিধান প্রণয়ন করেছেন। বিদ্যা, জ্ঞান ও সংস্কার দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম প্রাপ্ত হওয়া দ্বিজ অথবা ব্রাহ্মণ কে মনু অধিক সম্মান প্রদান করেছেন।
[ এখানে উল্লেখ্য যে, জন্মগত ভাবে কেউ ব্রাহ্মণ বা দ্বিজ হয় না। ইহা সংস্কার এবং শিক্ষা সাপেক্ষ]
এরূপ উচ্চজ্ঞানসম্পন্ন বিদ্বান লোক অধিক সামর্থবান হয় এবং সমাজের কল্যাণ আনয়ন করে। অতঃপর সেও যদি নিজ দায়িত্ব পালন না করে এবং স্বধর্ম হতে বিচ্যুত হয় তবে অবশ্যই সেও দন্ডভাগী হবে।
নিম্নে এরূপ কিছু শ্লোক প্রস্তুত করা হয়েছে-
.
=>> স্বধর্ম হতে বিচ্যুত মাতা, পিতা, আচার্য্য আদি সবাই রাজা কর্তৃক দন্ডনীয় হবে-
.
পিতাচার্য্য সুহৃন্মাতা ভার্য্যা পুত্রঃ পুরোহিতঃ।
নাদন্ড্যো নাম রাজোহস্তি যঃ স্বধর্মে ন তিষ্ঠতি।।৩৩৫
.
পদার্থঃ (পিতা আচার্য সুহৃত মাতা ভার্যা পুত্রঃ পুরোহিত) পিতা, আচার্য, স্ত্রী, মাতা পুত্র এবং পুরোহিত কেউ হোক না কেন (যঃ স্বধর্ম ন তিষ্ঠতি) যে স্বধর্মে স্থিত নয় (রাজঃ অদন্ডমঃ নাম ন) রাজা তাদের যথোচিত দন্ড প্রদান করবেন।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ৮।৩৩৫, ডঃ সুরেন্দ্রকুমার)
.
=>> অপরাধী রাজা সাধারনের চেয়ে অধিক সহস্রগুন দন্ড প্রাপ্ত হবে-
.
কার্ষপনং ভবেদ্দন্ড্যো যত্রান্যঃ প্রাকৃতো জনঃ।
তত্র রাজা ভবেদ্দন্ডঃ সহস্রমিতি ধারনা।।৩৩৬
.
পদার্থঃ (যত্র) যেই অপরাধে (অন্যঃ প্রাকৃতঃ জন) সাধারন মানুষের উপর (কার্ষপনং দন্ডদ্য, ভবেত) এক পণ দন্ড দেওয়া হয় (তত্র) সেই অপরাধে (রাজা, সহস্রং দন্ডদ্য, ভবেত) রাজা সহস্র পণ দন্ড প্রাপ্ত হবে।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ৮।৩৩৬, ডঃ সুরেন্দ্রকুমার)
.
=>>উচ্চবর্ণের ব্যক্তি বর্গ অধিক দন্ড প্রাপ্ত হবে-
.
অষ্টাপদ্যন্ত শুদ্রস্য স্তেয়ে ভবতি কিল্বিষম্।
ষোড়শৈব তু বৈশ্যেষ্য দ্বাত্রিংশৎ ক্ষতিয়স্য চ।।৩৩৭
ব্রাহ্মণস্য চতুঃষষ্টিঃ পূর্ণং ব্যাপি শতং ভবেৎ।
দ্বিগুনা বা চতুঃষষ্টিস্তদ্দোষগুনবিদ্ধি সঃ।।৩৩৮
.
পদার্থঃ এভাবে (তত দোষগুণাবিত হি সঃ) যে কিছু বিবেকী হয়েও (স্তেয়ে) চুরি করে (শুদ্রস্য তু অষ্টাপাদ্যম) শুদ্রকে সেই চুরির কারনে আট গুন (বৈশ্যস্য তু ষোড়শ+এব) বৈশকে যোল গুন (ক্ষত্রিয়স্য দ্বাত্রিংশত) ক্ষত্রিয়কে বত্রিশ গুন (ব্রাহ্মণস্য চতুঃষষ্টি) ব্রাহ্মণকে চৌষষ্টি গুন (অপি বা শতম) বা শত গুন (বা) অথবা (দ্বিগুন চতুঃষষ্টি) একশত আটাইষ গুন (কিত্বিবর্ষং ভবতি) দন্ড হওয়া উচিত। অর্থাৎ যার যেমন জ্ঞান এবং যার প্রতিষ্ঠা অধিক, সেই অপরাধে সেইরূপ অধিক দন্ড প্রাপ্ত হবে।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ৮।৩৩৭-৩৩৮, ডঃ সুরেন্দ্রকুমার)
.
=>> উপযুক্ত দন্ড প্রদান করে রাজা যশ এবং সুখ লাভ করবে-
.
অনেন বিধিনা রাজা কুর্ব্বাণঃ স্তেননিগ্রহম্।
যশোহস্মিন পাপ্তয়াল্লোকে প্রেত্য চানুত্তমংসুখম।।৩৪৩
.
পদার্থঃ (রাজা) রাজা (অনেন বিধিনা) উপরক্ত বিধি দ্বারা (স্তেননিগ্রহং কুর্বণিঃ) চোরকে নিয়ন্ত্রিত এবং দন্ডিত করে (অস্মিন্ লোকে যশঃ) এই জন্মে বা লোকমধ্যে যশ (চ) এবং (প্রেত্য) পরজন্মে (অনুত্তমং সুখম) উত্তম কে (প্রাপ্তুযাত) সুখ কে প্রাপ্ত করে।
(বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি ৮।৩৪৩, ডঃ সুরেন্দ্রকুমার)
.
অতএব মহর্ষি মনুর বচন অনুযায়ী অপরাধীর পদ অনুসারে তার দন্ড নির্ধারিত হবে। মনু মহারাজ ব্রাহ্মণকে এবং উচ্চ শাসক কে কঠোরতম দন্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু সমাজে দেখা যায় তার উল্টো। উচ্চ প্রভাবশালী বর্ণ যদি আপন কর্তব্যবিমুঢ হয় এবং নিন্দনীয় কার্যও করেন তবুও তার দন্ড অতন্ত্য লঘু হয়।
মনুঃ ৭।১৭-২০ এ স্পষ্ট বলা আছে, দন্ডই ন্যায়ের প্রচারক এবং দন্ডই অনুশাসনকর্তা। চার বর্ণ এবং জীবনের চার আশ্রমের রক্ষক। ইহা রাষ্ট্রকে জাগৃত রাখে। এইজন্য বিদ্বানরা দন্ডকে ধর্ম বলেন।