মনুস্মৃতি ও বর্ণ ব্যবস্থা

মনুস্মৃতি কে সৃষ্টি মধ্যে নীতি এবং ধর্মের (কানুন) নির্ধারন কারী সবচেয়ে প্রথম গ্রন্থ মানা হয়। এবং সেই সময় জন্মগত জাতিব্যবস্থার প্রথা ছিলো না। মহর্ষি মনুও জন্মগত ভাবে সিদ্ধ জাতিব্যবস্থার সমর্থন করে নি।মনু মহারাজ মানুষের গুন কর্ম স্বভাবের উপর আধারিত সমাজ ব্যবস্থা রচনা করার জন্য উপদেশ করেছে। এবং ইহাই সঠিক বর্ণ ব্যবস্থা। বর্ণ শব্দটি “বৃঞ” ধাতু থেকে এসেছে। যার অর্থ চয়ন বা নির্ধারন করা। এবং কর্ম এবং গুন দ্বারা বর্ণ নির্ধারিত হবে ইহাই ছিলো মনুর বিধান। কিন্তু বর্তমানে জন্মগত ভাবে বর্ণপ্রথা চালু রয়েছে। যা মনু কখনোই স্বীকার করে নি। উচ্চ বংশে জন্মগ্রহনকারীরা সব সময় নিম্ম বর্ণের মনুষ্যকে উপেক্ষিত করে চলে।এবং জন্মগত পরিচয়ে নিজেকে অনেক বড় বলে মনে করেন।
.
মনুস্মৃতি ৩।১০৯ – এ স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্য স্বীয় কুল গোত্রের পরিচয় প্রদান করিবেন না। ভোজনের জন্য কুল ও গোত্রের পরিচয় করিয়া ভোজন করিলে তাকে উদগীর্ণভোজী বলে।
অতএব মনুস্মৃতি অনুসারে, যে ব্রাহ্মণ বা উচু জাতি নিজ গোত্র বা বংশের পরিচয় দিয়ে নিজেকে বড় বলেন। এবং মার সম্মানের অপেক্ষা রাখে, অবশ্যই সে তিরস্কার যোগ্য।
.
মনুস্মৃতি ২।১৩৬ – ন্যায়সঞ্চিত ধন, পিতৃব্যাদি সমন্ধ্য, বয়োধিকতা, শ্রেষ্ঠ কর্ম, বেদার্থতত্বজ্ঞান রূপ বিদ্যা এই পঞ্চ সম্মানের উত্তরোত্তর মানদন্ড।
এই শ্লোকে কোন কুল, জাতি বা বংশ কে সম্মানের মানদন্ড মানা হয় নি।
.
=>বর্ণের পরিবর্তন –
.
মনুস্মৃতি ১০।৬৫ – ব্রাহ্মণ ও শুদ্র হতে পারে এবং শুদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারে। এই প্রকার ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যও নিজ নিজ বর্ণ পরিবর্তন করতে পারে।
.
মনুস্মৃতি ৯।৩৩৫ – শরীর এবং মন দ্বারা শুদ্ধ – পবিত্র এবং উৎকৃষ্ট লোকের সান্নিধ্যে স্থিত। মিষ্টিভাষী, অহংকার রহিত, নিজ থেকে উৎকৃষ্ট বর্ণের সেবাকারী শুদ্রও উত্তম ব্রহ্ম জন্ম বা দ্বিজ বর্ণকে প্রাপ্ত করতে পারে।
.
মনুস্মৃতি মধ্যে অনেক শ্লোক রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, উচ্চ বর্ণের ব্যক্তিও যদি শ্রেষ্ঠ কর্ম না করে তবে সে শুদ্র (অশিক্ষিত) বলে গন্য হবে।যেমন-
.
মনুস্মৃতি ২।১০৩ – যে মনুষ্য নিত্য প্রাত এবং সন্ধ্যায় ঈশ্বরের আরাধনা করে না তাহাকে শুদ্র বলে জানবে।
.
মনুস্মৃতি ২।১৭২ – যে ব্যক্তি বেদের শিক্ষাই দীক্ষিত হয় নি সে শুদ্র তুল্য।
.
মনুস্মৃতি ২।১৬৮ – যে ব্রাহ্মণ বেদের অধ্যয়ন বা পালন ছেড়ে অন্য বিষয়ে প্রযত্ন করেন সে শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়।
.
মনুস্মৃতি ৪।২৪৫ – ব্রাহ্মণ বর্নস্থ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ অতিশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সঙ্গ করে এবং নিচ থেকে নিচতর ব্যক্তির সঙ্গ ছেড়ে অধিক শ্রেষ্ঠ হয়। ইহার বিপরীত আচরনে পতিত হয়ে সে শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়।
.
অতঃএব ইহা স্পষ্ট যে, ব্রাহ্মণ উত্তম কর্ম কারী বিদ্বান কে বলে। এবং শুদ্রের অর্থ অশিক্ষিত ব্যক্তি। ইহা কোন জন্মগত সমন্ধ্য নয়।
.
মনুস্মৃতি ২।১২৬ – এমনকি কেন ব্রাহ্মণ হোক, কিন্তু যদি সে অভিবাদনের উত্তর শিষ্টতার সহিত দিতে না জানে, তবে সে শুদ্র।
.
অর্থাৎ মনু জন্মসিদ্ধ বর্ণ প্রথার সমর্থন করে নি। মনুস্মৃতি অনুসারে মাতা পিতা তার সন্তানদের বাল্যকালে তার রূচি এবং প্রকৃতি জেনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যের বর্ণের জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত করার জন্য উপদেশ প্রদান করবেন। কোন ব্রাহ্মণ পিতা মাতা যদি তার সন্তান কে ব্রাহ্মণ তৈরী করতে চায় তবে অবশ্যই তার মধ্যে ব্রাহ্মণোচিত গুণ,কর্ম, স্বভাব জাগিয়ে তুলবেন।
.
মনুস্মৃতি ২।১৫৭ – যেমন কাষ্ঠনির্মিত হস্তি ও চর্ম্মনির্মিত মৃগ কোন কার্যকারক নহে। তদ্রুপ যে ব্রাহ্মণ বেদাধ্যয়ন না করে তিনিও কোন কার্যক্ষম নহে। কেবল ব্রাহ্মণের নাম মাত্র ধারন করেন।
.
=>>শিক্ষাই বাস্তবিক জন্ম –
.
মহর্ষি মনুর মতে মানুষের বাস্তবিক জন্ম বিদ্যাপ্রাপ্তিতেই ঘটে। জন্মত প্রত্যেক মানুষই শুদ্র অর্থাৎ অশিক্ষিত। এবং সংস্কার দ্বারা সে পরিশুদ্ধ হয়ে তার দ্বিতীয় জন্ম হয়। আর একেই দ্বিজ বলে। সংস্কারে অসমর্থ ব্যক্তি শুদ্রই রয়ে যায়।
.
মনুস্মৃতি ২।১৪৮ – সমস্ত বেদশাস্ত্রের পারদর্শী আচার্য্য অভিজাত বালকের যথাবিধিনুসারে গায়ত্রী উপদেশ করিয়া যে যথার্থ জন্ম উৎপাদন করেন, সে জন্মই ব্রহ্মপ্রাপ্তির কারন বলিয়া অজর ও অমর রূপে গণ্য হয়।
.
মনুস্মৃতি ২।১৪৬ – জন্মদাতা পিতা থেকে জ্ঞান দাতা আচার্য্য অধিক বড় এবং মাননীয়। আচার্য্য দ্বারা প্রদান করা জ্ঞান মুক্তি প্রদান করে। পিতা দ্বারা প্রদত্ত শরীর তো এই জন্মের সাথেই নষ্ট হয়।
.
=>> শুদ্রের প্রতি ভালো ব্যবহার
.
মনু পরম মানবীয় ছিলেন। তিনি জানতেন যে, কোন শুদ্র ইচ্ছাকৃত ভাবে শিক্ষাকে উপেক্ষা করতে পারবে না। তারা কোন কারন বশত জীবনের প্রথম ধাপে জ্ঞান এবং শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ জন্য মহর্ষি মনু শুদ্রদের জন্য সমাজে উচিত সম্মানের বিধান করেছেন। তিনি শুদ্রদের প্রতি কখনো অপমান সূচক শব্দ ব্যবহার করেন নি। মনুর দৃষ্টিতে জ্ঞান ও শিক্ষার অভাবে শুদ্র সমাজের মধ্যে সবচেয়ে অসহায়। যা পরিস্থিতির বশ। সে জন্য মনু সমাজে তাদের প্রতি অধিক সহৃদয়তা এবং সহনাভূতি দেখাতে বলেছেন –
.
মনুস্মৃতি ৩।১১২ – শুদ্র বা বৈশ্য অতিথি রূপে আসলে ব্রাহ্মণ তাকে সম্মানের সহিত ভোজন করাবেন।
.
মনৃস্মৃতি ৩।১১৬ – আপন সেবক (শুদ্র) কে প্রথম ভোজন করানোর পর দম্পতি ভোজন করবেন।
.
=>> মনুস্মৃতি বেদের উপর আধারিত
.
বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান এবং সমস্ত বিদ্যা বেদ থেকেই নির্গত হয়। এবং বেদ কে মেনেই ঋষিরা অন্য সব গ্রন্থ রচনা করেছেন।বেদের স্থান এবং প্রামানিকতা সবার উপরে। এবং অন্যান্য স্মৃতি শাস্ত্রও মান্য যদি সেগুলো বেদানুকুল হয়। এবং বেদ যে ধর্মের মূলে মনু ইহা দৃঢতার সহিত মান্য করতেন।
.
মনুস্মৃতি ২।৮ – শাস্ত্র সকল জ্ঞানচক্ষু দ্বারা বিশেষরূপে পর্যালোচনা করিয়া বিদ্বানরা বেদমূলক কর্তব্যকর্ম্ম অবগত হইয়া তাহার অনুষ্ঠান করিবেন।
.
মনুস্মৃতি ২।১৩ – ধর্ম্ম জিজ্ঞাসু ব্যক্তির নিকট প্রকৃষ্ট প্রমাণ বেদ। যেহেতু বেদ ও স্মৃতির অনৈক্যে বেদের মতই গ্রাহ্য হয়।
.
এখানে ইহা স্পষ্ট যে, মনুর বিচার এবং মূল রচনা বেদানুকুল। তিনি বেদের আধারেই উপদেশ করেছেন। কিন্তু যদি মনুস্মৃতিতে বেদ বিরুদ্ধ কোন উপদেশ পাওয়া যায় , অবশ্যই তাহা প্রক্ষিপ্ত জানবে। কারন মনু বেদের বাহিরে গিয়ে কোন উপদেশ করেন নি। কিছু স্বর্থান্বেষী তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তাদের মনগড়া শ্লোক সংযোজন করেছেন। যা সম্পূর্ণই ভ্রান্ত এবং বেদ বিরুদ্ধ।
.
অতএব মহর্ষি মনুর মত অনুসারে, বর্ণব্যবস্থা জন্মগত নয়। ইহা গুন, কর্ম এবং স্বভাব জাত। নিম্ন জাত বলে কাউকো হেয় করা নয়। বরং তাদেরকে সম্মান করা। বাস্তবিক ইহাই তো ধর্ম। মহর্ষি মনুর তো ইহাই চরম সিদ্ধান্ত। তাই তো তিনি বলেছেন-
যাহাতে ধর্ম রক্ষা হয়, এমত যত্ন করিবে। জগতে ধর্ম হতে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নাই। (মনুঃ ৮।১৭)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *