বেদে গৌরাঙ্গের কথা একটি ভ্রান্ত ধারণা।

বেদ নিয়ে যেন পৌরাণিকদের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। তারা তাদের কাল্পনিক চিন্তাধারা বেদের মধ্যে প্রতিফলিত করতে চায়। যেমনঃ রাম অবতার, কৃষ্ণ অবতার, কাল্পনিক রাধা চরিত্র ইত্যাদি। এমন কি বাদ যায় নি কলি যুগের নিমাই সন্ন্যাসি (গৌরাঙ্গ)। তাদের দাবী হচ্ছে, বেদে নাকি নিমাই (গৌর) এর ভবিষ্যত বাণী করা হয়েছে। এবং বলা হয়েছে তিনি না কি কীর্তন প্রচার করবেন। তারা নিম্নক্তো দাবী উপস্থাপন করে –

.

=>> দাবী -০১

সেমং নঃ স্তোমমা গহ্যুপেদং সবনং সুতম। গৌরো ন তৃষিতঃ পিব।।

(ঋগবেদ ১।১৬।৫)

.

হে ভগবান গৌর! সূর্যরশ্নি সম্মিলনা কাঙ্ক্ষী চন্দ্রের মতো তৃষিত এই ভক্তমন্ডলীর সমীপে আগমনপূর্বক দিব্য সংকীর্তনানন্দ আস্বাদন করুন।

.

দাবীর সত্যতাঃ

সম্পূর্ণ মনোকল্পিত অনুবাদ এটি।মহর্ষী যাস্কের মতে বেদ মন্ত্রের অনুবাদ মন্ত্রের প্রকরন এবং দেবতা অনুয়ায়ী করা উচিত। কিন্তু উক্ত অনুবাদে এর কোনটাই মানা হয় নি। অনুবাদক যেন তার মনের মাধুরি মিশিয়ে অনুবাদ করেছেন। যা কল্পনা ব্যতিত আর কিছুই নয়। যথার্থ অনুবাদ হচ্ছে –

.

” হে ইন্দ্রেদেব! আমাদের স্তোত্র শ্রবন করতে আপনি এখানে আসুন। তৃষ্ণার্থ গৌর মৃগের ন্যায় ব্যকুল মনে সোমের অভিষেক স্থানের নিকট এসে সোম পান করুন ”

.

উপরিউক্ত মন্ত্রে দেখা যাচ্ছে যে, ওখানে “গৌর মৃগের ” কথা বলা হয়েছে। নিমাই (গৌরাঙ্গদেব) এর কথা বলা হয় নি। মন্ত্রে গৌর একটি বর্ণ বিশেষ। এই গৌর শব্দের উল্লেখ আমরা যজুর্বেদ ১৩।৪৮ এ পাই-

” গৌরমারণ্যমনু তে দিশামি…….গৌরং তে শুগৃচ্ছতু যং দ্বিশস্তং শৃশুগচাছতু”

.

এর অনুবাদে বলা হয়েছে, তোমার শোক, সন্তাপ বা ক্রোধ গৌর মৃগের প্রাপ্ত হোক।

যদি এখানে আমরা গৌর = নিমাই (গৌরাঙ্গ) অর্থ করি তাহলে মন্ত্রটির অর্থ দাড়ায় –

“তোমার শোক, সন্তাপ বা ক্রোধ নিমাই(গৌর) এর প্রাপ্ত হোক”

এরকম অর্থ কি তারা স্বীকার করবেন?

সর্বাশ্চার্যের বিষয় এই যে পৌরাণিকদের শিরোমনি রমেশ দত্তও উক্ত মন্ত্রে নিমাই (গৌর) কে খুজে পান নি।

.

“হে ইন্দ্র! তুমি আমাদের স্তুতি গ্রহন করিতে আসো। যেহেতু যজ্ঞসবন অভিযুত হইয়াছে। তুমি তৃষিত গৌর মৃগের ন্যায় পান কর”

.

=>> দাবী – ০২

অগ্নেঃ পূর্ব্বে….বরুণং দুরমায় গৌরো ন ক্ষেপ্নোরবিজে জ্যায়া।।

(ঋগবেদ ১০।৫১।১৬)

.

আমি আমার পূর্বতন ব্রহ্মাদি ভ্রাতাদের মৃত্যু দর্শন করে মৃত্যভয়ে ভীত হয়ে বহু দেশ ভ্রমন করার পর মৃত্যুর লক্ষের বাইরে শ্রী গৌরদেবের চরন আশ্রয় করেছি – যা আশ্রয়ে নিরুদ্বেগ হওয়া যায়।

.

দাবীর সত্যতাঃ

এ মন্ত্রেও সেই একই কল্পনার আশ্রয়। তাদের যেন মন্ত্রে গৌর শব্দটি পেলেই হলো আর কিছুই দেখার প্রয়োজন নেই। মন্ত্রটিকে একেবারে চৈতন্য চরিতামৃত বানিয়ে ছাড়বে। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা এরকমটি জানলে হয়তবা আগেই দেহত্যাগ করতেন।

মন্ত্রটির যথার্থ অনুবাদ-

.

“যেই প্রকারে রথী মার্গে গমন করে লক্ষ্যে পৌছে, এভাবে আমার তিন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এই যজন কার্য করতে গিয়ে মৃত্যু প্রাপ্ত হয়েছে। হে বরুনদেব! এই ভয়ে আমি চিন্তিত হয়ে সুদূরে চলে এসেছি। ধনুধারীর বাণ দ্বারা যেই প্রকারে হরিণ ভয়ে ভীত হয়, সেই প্রকারে আমি যজন কার্যে ভয়ে ভীত”

.

এই মন্ত্রেও গৌর= মৃগের কথা বলা হচ্ছে। নিমাই (গৌরাঙ্গ) এর কথা নয়। অতএব ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। এবার রমেশ দত্তের অনুবাদে আসি। তিনি কি এই মন্ত্রে নিমাই(গৌরাঙ্গ) এর কথা স্বীকার করেছেন?

চলুন দেখে নেওয়া যাক-

.

” অগ্নির পূর্ব্বতন ভ্রাতাগন, যেমন রথী দূরপথ পর্যটনে প্রবৃত্ত হয়, তদরূপ এই কার্যে ব্রতী হইয়া বিষ্ট হইয়াছে। হে বরুন! এই নিমিত্ত ভয়প্রযুক্ত আমি দূরে চলিয়া আসিয়াছি। যেরূপ শ্বেত হরিণন ধনুকের গুন দেখিলে বাণের ভয় প্রাপ্ত হয়। তদ্রুপ আমিও উদ্বিগ্ন হইয়াছি”

.

অতএব দেখা যাচ্ছে যে, কোন অনুবাদকই উক্ত মন্ত্রগুলোতে নিমাই(গৌরাঙ্গ) এর কথা স্বীকার করেন নি। দাবীগুলো যে ভ্রান্ত ছিলো তাহা সুস্পষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *